মহিউদ্দিন ইউপি চেয়ারম্যান থেকে এমপিঃকবিরের ৬১ হাজার ভোট ও মাহী’র পরাজয়ের নেপথ্যে

আরিফ হোসেনঃ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মুন্সীগঞ্জ-১ আসন ছিল সারাদেশের মধ্যে অন্যতম আলোচিত আসন।এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোঃ মহিউদ্দিন আহমেদের পাশাপাশি প্রতিদ্বন্দ্বীতায় ছিলেন নৌকার মনোনয়ন না পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম সারোয়ার কবির,বিকল্পধারার যুগ্ন মহাসচিব মাহী বি.চৌধুরী,তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপার্সন অন্তরা সেলিমা হুদা,জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম,বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সভাপতি আতাউল্লাহ হাফেজ্জি সহ মোট ৯ জন।

নির্বাচনী হাওয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই গুঞ্জন শুরু হয় এই আসনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী দিবে নাকি সমমনা কোন দলকে আসনটি ছাড় দিবে। কিন্তু সকল জল্পনা শেষে মহিউদ্দিন আহমেদকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। এর পরও সংশয় ছিল শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী রাখে কিনা। কিন্তু সকল জল্পনা কল্পনাকে ভুল প্রমান করে এই আসন থেকে মহিউদ্দিন আহমেদ ৩৪ হাজারের বেশী ভোট পেয়ে বেসরকারী ভাবে আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন।

মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের মহিউদ্দিন আহমেদের প্রাপ্ত ভোট ৯৫ হাজার ৮৬০ । মহিউদ্দিন আহমেদের নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী ট্রাক প্রতিকের স্বতন্ত্রপ্রার্থী গোলাম সারোয়ার কবির পেয়েছেন ৬১ হাজার ৫৪০ ভোট। এই আসনে বিকল্পধারার প্রার্থী মাহী বি,চৌধুরী পেয়েছেন ১৭ হাজার ৯৩৩ ভোট,তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপার্সন অন্তরা সেলিমা হুদা পেয়েছেন ৬ হাজার ৩৩৭ ভোট। আসনটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ৮ হাজার ৯৮৬। এর বিপরীতে বাতিল ভোট ব্যাতীত মোট ভোট গ্রহন হয়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৩৬৩। যা মোট ভোটারের ৩৭ ভাগ।

মহিউদ্দিন আহমেদের জয়ী হওয়া,গোলাম সারোয়ার কবিরের ৬০ হাজারের বেশী ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হওয়া এবং আসনটির সর্বশেষ সংসদ সদস্য মাহী বি.চৌধুরীর শোচনীয় পরাজয় নিয়ে বিভিন্ন স্থানে আলোচনা হচ্ছে বিস্তর। শ্রীনগর পোস্টের অনুসন্ধানে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের নির্বাচনী পোস্টমর্টেমে যা উঠে এসেছে তা হলো-

মহিউদ্দিন আহমেদের জয়ের নেপথ্যেঃ সিরাজদিখান উপজেলা পরিষদের ও মালখানগর ইউনিয়ন পরিষদের একাধিকবার নির্বাচিত চেয়ারম্যান মোঃ মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি এই উপজেলা আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সভাপতি। তৃণমূল থেকে উঠে আসা এই নেতার প্রতি আস্থা রেখে আওয়ামী লীগ তাকে দলীয় প্রার্থী মনোনীত করে। একারণে দলটির নৌকা প্রতিকের ভোট ব্যাংকের বড় অংশ তার সাথে ছিল। তাছাড়া মহিউদ্দিন আহমেদ স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি থাকার কারনে সিরাজদিখান উপজেলা জুরে তার নিজস্ব একটি বলয় রয়েছে। তার লোক হিসাবে পরিচিতরা মহিউদ্দিন আহমেদকে জয়ী করতে নির্বাচনে মরিয়া ভূমিকা রাখে। অবশ্য এই উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সহ বেশ কয়েকজন ইউপি চেয়ারম্যান তার বিরুদ্ধে কাজ করলেও তাকে পরাজিত করতে পারেনি।

মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের অপর উপজেলা শ্রীনগর। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর হয়ে এখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ¦ তোফাজ্জল হোসেন,উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ মসিউর রহমান মামুন,উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ওয়াহিদুর রহমান জিঠু সহ উপজেলা আওয়ামী লীগ,সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও উপজেলার দুই একটি বাদে ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধি বৃন্দ সহ আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকরা মিলে মহিউদ্দিন আহমেদকে জয়ী করতে ভূমিকা রেখেছেন। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগার হিসাবে নৌকা প্রতিককে বিজয়ী করতে সচেষ্ট ভূমিকাই সফলতা এনে দিয়েছে।

গোলাম সারোয়ার কবির কেন পারলেন নাঃ ঢাকা মহানগর দক্ষিন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা গোলাম সারোয়ার কবির। মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি সুকুমার রঞ্জন ঘোষ পরবর্তী সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের পাশে থেকেছেন। দুই উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নেই তার পরিচিতি রয়েছে। তিনি মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে ব্যার্থ হন। পরে নেতা কর্মীদের উৎসাহ দেখে নিজে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন এবং নির্বাচনে ৬০ হাজারের বেশী ভোট পেয়েছেন। সিরাজদিখান উপজেলায় তার হয়ে কাজ করেছেন সিরাজদিখান উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বৃন্দ। মূলত আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোঃ মহিউদ্দিন আহমেদের বিরোধী পক্ষই সিরাজদিখানে তার সাথে যোগ দেয়। সেখানে গোলাম সারোয়ার কবিরের প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা ৩৪ হাজার ৭৩৬ ভোট। কিন্তু শ্রীনগরের ভোটার গোলাম সারোয়ার কবির নিজ উপজেলায় পেয়েছেন ২৬ হাজার ৮০৪ ভোট। এর কারন হিসাবে উঠে আসছে শ্রীনগরে তার হয়ে নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য সিরাজদিখানের মতো উপজেলা লেভেলে কোন অভিজ্ঞ নেতা ছিলেন না।

অপরদিকে গোলাম সারোয়ার কবিরের সাথে শ্রীনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ওয়াহিদুর রহমান জিঠুর এক সময় সখ্যতা ছিল তুঙ্গে। কিন্তু প্রায় ২ বছর আগে তাদের মধ্যে দুরত্ব তৈরি হয়। সর্বশেষ গত বছর শ্রীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হন শ্রীনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মসিউর রহমান মামুন ও ভাইস চেয়ারম্যান ওয়াহিদুর রহমান জিঠু। সভাপতি পদে একক প্রার্থী ছিলেন তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আলহাজ¦ তোফাজ্জল হোসেন। কিন্তু সম্মেলনের খুব কাছাকাছি এসে সভাপতি পদে প্রতিদ্ব›দ্বীতার ঘোষণা দেন তৎকালীন সিনিয়র সহ সভাপতি সেলিম আহমেদ ভূইয়া। সম্মেলনের একদিন আগে সেলিম আহমেদ ভূইয়া প্রতিদ্বন্দ¦ীতা থেকে সরে যান এবং আলহাজ¦ তোফাজ্জল হোসেন সভাপতি ও মোঃ মসিউর রহমান মামুন সাধারণ সম্পাদক পদে অনেকটা প্যানেল ঘোষণা করার মতো করে ঐক্যবদ্ধ হন। সম্মেলনে জিঠু ভোটে হেরে যান। এসবের পেছনে গোলাম সারোয়ার কবীরের হাত রয়েছে বলে মনে করে ওয়াহিদুর রহমান জিঠু। এর পর থেকেই তাদের দুজনের বৈরিতা আরো বেশী ঘনিভূত হয়। যা জোরালো ভাবে প্রকাশ পেয়েছে এই নির্বাচনে।

গত ৭ জানুয়ারীর নির্বাচনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মসিউর রহমান মামুনও গোলাম সারোয়ার কবিরের পক্ষে ছিলেন না। গোলাম সারোয়ার কবিরের হারের পেছনে এটিও একটি কারণ হিসাবে দেখছে অনেকেই। তাছাড়া আওয়ামী ঘরণার বাইরের ভোট সংগ্রহ করতে না পারাও তার হারের অন্যতম কারণ। তারপরও স্রোতের বিপরীতে থেকে সাড়ে ৬১ হাজার ভোট পাওয়াকে অনেকেই খাটো করে দেখছেন না। অনেকে মনে করেন আরেকটু কৌশলী হলে হয়তো তিনি জিতে যেতেন।

মাহী বি.চৌধুরীর পরাজয়ের নেপথ্যেঃ মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে রাজনৈতিক ভাবে ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান মাহী বি.চৌধুরী। তার দাদা আওয়ামী লীগের এমপি,বাবা বিএনপির ব্যানারে একাধিকবার নির্বাচিত এমপি ও মন্ত্রী ছিলেন। সর্বশেষ তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। মাহী বি.চৌধুরীও বিএনপি,বিকল্পধারার এমপি হয়েছেন ২ বার। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে জোট বেধে এমপি নির্বাচিত হন। কিন্তু এই নির্বাচনে দুই উপজেলা মিলে প্রায় ১৮ হাজার ভোট পেয়েছেন। আসনটির সর্বশেষ এমপি হিসাবে এটা হতাশাজনক বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

আওয়ামী লীগের ব্যানারে এমপি নির্বাচিত হওয়ায় গত ৫ বছর আওয়ামী লীগের অনেক নেতা কর্মীর সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। বিশেষ করে তিনি উন্নয়ন কাজের জন্য সৎ ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত শ্রীনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মসিউর রহমান মামুনের উপর আস্থা রাখেন। মাহী বি.চৌধুরীর সাথে দুই একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও সম্পর্ক গড়ে তুলেন। এই নির্বাচনে তাদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি অংশ প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে মাহী বি,চৌধুরীর জন্য কাজ করবেন বলে হয়তো বিকল্পধারার প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত এসকল জনপ্রতিনিধিরা তাদের দলের বাইরে গিয়ে কুলা প্রতিকের জন্য কাজ করেননি। বিকল্পধারা নির্বাচনে বিএনপির ভোটারদের সুবিধা পাবেন এমন প্রত্যাশাও ছিল। কিন্তু বিএনপির ভোটারটা কুলা প্রতিকে ভোট দেওয়ার বিষয়ে তেমন সারা দেয়নি বলেই তিনি ভোটে তেমন আগাতে পারেননি।
মাহী বি.চৌধুরী নির্বাচন করার জন্য গত ৫ বছরে তার দলটিকেও গুছাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও মাহী বি.চৌধুরী দাবী করেন কর্মী যত কম জনগনের শান্তি ততো বেশী। তবে মাহী বি.চৌধুরীকে সবচেয়ে বেশী ভোটার বিমুখ করেছে এলাকায় সময় না দেওয়া। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে তাকে কাছে পাওয়া যায়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে ভোটারদের। একারণে সিরাজদিখান উপজেলায় তার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা মাত্র সাড়ে ৫ হাজার। একটি উপজেলায় ১৪টি ইউনিয়নে একজন রানিং এমপির এই ভোট সংখ্যাই প্রমান করে ভোটাররা তার উপর কতটা ক্ষিপ্ত। তবে মাহী বি.চৌধুরী নির্বাচনের আগে ভোটরদের কাছে তার অনুপুস্থিতির ভুল স্বীকার করে তাকে ভোট দেওয়ার আহবান জানান। কিন্তু তাতে তেমন সারা মিলেনি।

স্থানীয়দের অনেকে মনে করেন, আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত মাহী বি.চৌধুরীকে তাদের নির্বাচনী জোটের প্রার্থী হিসাবে মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে নৌকায় তুলবে এই বিশ্বাসের কারনেই হয়তো মাহী বি,চৌধুরী বিকল্পধারার প্রার্থী হয়ে একক ভাবে নির্বাচন করবেন এমন প্রস্তুতি নেননি। একারণেই শেষ মুহুর্তের তোরজোরে আর শেষ রক্ষা হয়নি।

এই ৩ জনের বাইরে তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপার্সন অন্তরা সেলিমা হুদার পিতৃভূমি দোহার সংলগ্ন শ্রীনগর উপজেলার বাঘড়া ইউনিয়নে জয়লাভ করেছেন। এছাড়া বাকী প্রার্থীদের কেউ উল্লেখ যোগ্য ভোট সংগ্রহ করতে পারেননি।